শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
একটি পারিবারিক সহিংসতা। দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে কেড়ে রেখে সিথি’কে (ছদ্মনাম) স্বামী বাড়ী থেকে বের করে দেয়। সুজন (ছদ্মনাম) জোরপূর্বক নিজের কাছে সন্তানকে আটকে রাখে। দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে কাছে পেতে মা অস্থির হয়ে উঠে। অবশেষে সন্তানকে নিজ জিম্মায় পাওয়ার আশায় আদালতের শরণাপন্ন হন সিথি। বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারার বিধান মতে পিটিশন মামলা দায়ের করেন। শুরু হয় সন্তান নিয়ে দুই পক্ষের রশি টানাটানি।
১০০ ধারার সার্চ ওয়ারেন্টের বিধান কেবলমাত্র বেআইনিভাবে আটককৃত ব্যক্তির ওপর প্রযোজ্য। সেকারণ, সন্তানের আইনগত অভিভাবক যেহেতু পিতা, তাই সন্তান যদি তার বাবার কাছে থাকে, তা বেআইনি আটক হবে না। সন্তানের কল্যাণ বাবা নাকি মায়ের তত্ত্বাবধানে হবে সেই সিদ্ধান্ত নির্বাহী বা অন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেট দিতে পারেন না। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ এর ৫ ধারা মতে, সন্তানের কাস্টডির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের।
আইনের অসংখ্য জটিলতা মেনে সিথি এবার যায় পারিবারিক আদালতে। পাঁচ বছর আগে মামলা করেছেন তিনি। মামলা দায়েরের পর বিবাদীর কাছে সমন (মামলা সংক্রান্ত নোটিশ) জারি করতে আদালতের সময় লেগেছে দুই বছর। অপরপক্ষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় তদবির করে মামলার ধার্য তারিখ দু-তিন মাস পর পর বিলম্বিত করতে থাকে। এ মামলা যে কবে শেষ হবে, তা নিয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে সিথি। দুগ্ধপোষ্য সন্তান রেখে বাবার বাড়িতে নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটতে থাকে তার। অবশেষে আদালত সিথির পক্ষে রায় দেন। বিবাদী সুজন ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। যথাসময়ে নিম্ন আদালত থেকে সিথি রায় পেলেও উচ্চ আদালতে দায়ের হওয়া নতুন এই আপিল মামলা চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য ও মনোবল তার নেই। মামলা করে যেন আরো বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।
অধিকার আদায়ের সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে নারীরা আশ্রয় নেন পারিবারিক আদালতে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, মামলা চালানোর অর্থাভাব, অপর পক্ষ থেকে মানসিক চাপ সবমিলিয়ে নারী হয়ে পড়ে চরম দুর্দশাগ্রস্থ। একজন নারী যিনি সন্তান ফিরে পেতে মামলা করেন, তাকে যদি বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হয় তাহলে ন্যায়বিচারের আশা উবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারলেই যেন রেহাই পান আবেদনকারিণী। সেই সাথে সন্তানকে কাছে পেতে গর্ভধারিণী মায়ের অপেক্ষার প্রহর যেনো দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর হয়।
এছাড়াও বাংলাদেশে অভিভাবকত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন-১৮৯০ এর বিধানসমূহ অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ও বিধিবদ্ধ উভয় আইনে একমাত্র পিতাই নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক। মুসলিম আইনে মা কেবলমাত্র সন্তানের জিম্মাদার মাত্র। পুত্র শিশুর বয়স ৭ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা শিশুর বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মা তাদের নিজ জিম্মায় রাখার অধিকারী। হিন্দু আইনে পিতার অবর্তমানেই কেবল মাতা অভিভাবক হন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে হিন্দু আইন প্রযোজ্য। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা জুডিশিয়াল সেপারেশনের সময় মা আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক হতে পারেন।
Ramesh v. Smt Laxmi Bai 1999, Cri LJ ৫০২৩ মামলায় ৯ বছরের ছেলে বাবার সঙ্গে বসবাস করাকালীন সময়ে ওই শিশুর মা আদালতে সার্চ ওয়ারেন্ট মামলা আনয়ন করেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, বাবার কাস্টডি হতে মায়ের কাস্টডিতে শিশুকে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সার্চ ওয়ারেন্ট আকৃষ্ট করে না বিধায় ওই মামলা চলতেই পারে না।
Shri Atanu Chakraborty vs The State Of West Bengal & Anr (C.R.R. No. 3870 of 2009) মামলায় ৪ বছরের ছেলে-সন্তানকে বাবার কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য মা কর্তৃক সার্চ ওয়ারেন্টের আবেদনের ভিত্তিতে ভারতের বিধাননগরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে পুলিশকে নির্দেশ দেন ওই নাবালককে উদ্ধার করে আদালতে হাজির করতে এবং বাবাকেও হাজির থাকতে। সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু সংক্রান্ত ওই আদেশের বিরুদ্ধে নাবালকের বাবা কলকাতা হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করেন। ক্রিমিনাল রিভিশন মামলার রায়ে বাবার কাস্টডি থেকে নাবালক ছেলেকে উদ্ধারের জন্য দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সার্চ ওয়ারেন্ট সংক্রান্ত আদেশ আইনসম্মত নয় বিধায় বাতিল করা হয়। হাইকোর্ট বলেন, বাবার বিরুদ্ধে অন্যায় আটক অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে, যেখানে Hindu Minority and Guardianship Act, ১৯৫৬-এর ৬ ধারা মতে ছেলেসন্তানের ক্ষেত্রে বাবা এবং বাবার পরে মা হলো স্বাভাবিক অভিভাবক। নাবালক ছেলের বয়স ৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মায়ের কাস্টডিতে থাকার কথা। আদালতের আদেশ লঙ্ঘন না করে থাকলে, ৫ বছরের কম বয়সী নাবালক ছেলে তার বাবার কাস্টডিতে থাকলে তাকে অন্যায় আটক বলা যাবে না। ওই মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদালত বলেন, বাবার সঙ্গে নাবালক ছেলের বসবাস থাকায় সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যুর প্রশ্নই আসে না। পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, এঁধৎফরধহ ্ ডধৎফং অপঃ, ১৮৯০-এর বিধান মতে নাবালকের কাস্টডির জন্য পক্ষদ্বয় উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতে যেতে পারেন। দেওয়ানি আদালতের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত মা ৪ বছরের নাবালক ছেলের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবেন কি-না, এই প্রশ্নের বিষয়ে উচ্চ আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বলেন, উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতে নাবালকের তত্ত্বাবধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত নাবালক তার বাবার কাস্টডিতেই থাকবে।
‘ইমামবন্দি বনাম মুসাদ্দির ২২ ডিএলআর, পৃষ্টা ৬০৮’ মামলায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম আইনে সন্তানের শরীরের ব্যাপারে লিঙ্গভেদে কিছু বয়স পর্যন্ত মা তত্ত্বাবধানের অধিকারীনি। মা স্বাভাবিক অভিভাবক নন। একমাত্র পিতাই বা যদি তিনি মৃত হন তাঁর নির্বাহক আইনগত বা বৈধ অভিভাবক।’ তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মা এ অধিকার হারাবেন। [হেদায় ১৩৮, বেইলি ৪৩৫]। সস্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ক্ষেত্রে অবশ্য মায়ের দ্বিতীয় স্বামী সন্তানের রক্ত সম্পর্কীয় নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে একজন না হলে মা তার তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা হারাবেন।
তবে আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডি এল আর এর মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৬ ডিএলআর এ জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলেন, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই।
অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। তবে সবার মনে রাখার দরকার ‘বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করে’।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮